Print This Publication

গন্ধের পৃথিবী হতে—তানিয়া চক্রবর্তী

 গন্ধের পৃথিবী হতে  


PERFUME এই ল্যাটিন শব্দটি “PER” অর্থাৎ মাধ্যম এবং “FUMUS” অর্থ ধোঁয়া।এই পারফিউমের রহস্য আসলে ভাবনার বাইরে। এর গঠনের, গন্ধের, রহস্যজনিত এতো এতো দিক যে ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।টপ্পুটি বেলাতেকালিম (TAPPUTI BELATEKALLIM) পৃথিবীর প্রথম মহিলা রসায়নবিদ, যিনি প্রথম পারফিউম নির্মাতা হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত।প্রাচীন মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন ভাষার তথ্যে এটি লিখিত রয়েছে।১২০০ খ্রীঃপূঃ তে মেসোপটেমিয়ার ব্যবিলনিয়াতে তার আগমনকাল বলে ধরে নেওয়া হয়। তার ব্যবহারিক দ্রব্যের মধ্যে ছিল ফুল, তেল, সাইপ্রাস, বালসাম এবং বিশেষত ক্যালামাস। বালাসাম যেমন বিশেষ ধরণের গাছ থেকে তৈরী হওয়া রজন আর ক্যালামাস এক অদ্ভুত ধরণের ফুলের গাছ। যার মধ্যে সাইকোঅ্যাক্টিভ রাসায়নিক আছে, ফলত গন্ধ দ্বারা মোহিত হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক উপাদান এখানেই জড়ো হয়ে গেল।সুগন্ধীর এই পর্যায়ে আসতে যাদের অবদান আলাদা তাদের অন্যতম হল মল তথা বর্জ্য পদার্থ। অ্যাম্বারগ্রিস, স্ক্যাটোল এরা হল সেই মল যা পারফিউম স্রস্টারা ফিক্সেটিভ হিসেবে ব্যবহার করে। এর ওপর নির্ভর করে গন্ধের স্থায়িত্ব রচিত হয়।SPERM WHALE তথা সবথেকে বড় এই তিমির মলই হল অ্যাম্বারগ্রিজ। এর মূল্য চমকে দেওয়ার মতো। সমুদ্রের তটে, ভাসমান অবস্থায় সমুদ্রে, এমনকী মৃত তিমির অন্ত্র থেকেও একে বার করে এনে ব্যবহার করা হয়।সাধারণত আটলান্টিক,সাউথ আফ্রিকা,মাদাগাস্কার,চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র উপকূলগুলোতে এর দেখা মেলে।২০২১ এ ২৮০ পাউন্ডের একটি অ্যাম্বারগ্রিস পেয়েছিলেন এক জেলে ইয়েমেনের সমুদ্র উপকূলে। যার মূল্য ছিল ১.৭৫মিলিয়ন ইউএস ডলার।এবার আসি স্ক্যাটোলের কথায়; স্তন্যপায়ীদের ও পাখিদের মলের সেই উপাদান মূলত যা মলের বিশেষ প্রকার গন্ধ তৈরীতে দায়ী জৈব রাসায়নিক উপাদান।এই একই যৌগিকের লঘু ঘনত্বের গন্ধ হল ফুলের গন্ধের মতো। বহু ফুলে, ভেষজ তেলে, কমলার ফুলে,রজনীগন্ধায় সেই গন্ধ পাওয়া যায়। ফলত এটিও অ্যাম্বারগ্রিসের মতো পারফিউমের উপাদানের ফিক্সেটিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জার্মানির ডাক্তার লুডউইগ ব্রেইগার এই আবিষ্কারটি করেছিলেন।“মনেল কেমিক্যাল সেন্সেস সেন্টারের” একটি বিশেষ গবেষণায় পাওয়া গেছে মানুষের মধ্যে মহিলাদের মল তথা বর্জ্যপদার্থের মধ্যে পুরুষের থেকে আকর্ষণের ক্ষমতা বেশী।নিউরোসাইন্টিস্ট জানিনা সিউবার্ট এই বিশেষ গবেষণাটি করেছিলেন। ২০১৮ তে জার্মান নির্দেশক ফিলিপ কাডেলবাচের একটি থ্রিলার সিরিজ মুক্তি পায় “PERFUME” নামে যার প্রেক্ষাপটি ছিল ২০০৬ সালে টম টিকওয়ার পরিচালিত “পারফিউম” ছবিটি। এইখানে গন্ধের এক ব্যতিক্রমী উৎস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে নারীর সিবেসিয়াস গ্রন্থি সংলগ্ন চামড়ার অংশ। দেখানো হয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক নগ্ন মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে মেয়েদের ,যাদের মাথায় ও শরীরের বিশেষ বিশেষ গন্ধ উদ্রেককারী জায়গার চামড়া ছেঁচে গ্রন্থিসমেত উপড়ে নেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য কেবলই অত্যাশ্চর্য সুগন্ধী তৈরীর।ছবির শেষে অন্যায়কারী ধরা পড়ে কিন্তু দেখা যায় গন্ধের বাসনা থেকে কারো মুক্তি নেই। এই একই ভাবকে অবলম্বন করে পারফিউমার বলেও ছবি তৈরী হয়। পারফিউম তৈরীর যে মাধ্যম তার তিনটে মাত্রা আছে Top note, Middle note, Base note। এটি মিশ্রণ তৈরী এক অপূর্ব পদ্ধতি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আরবের প্রখ্যাত পারফিউম কোম্পানি “আল-হারমাইন” এর এই পারফিউম প্রক্রিয়াকরণকে দেখার । এই যে উল্লিখিত মাত্রা (note) তা ফিল্মেও দেখানো হয়েছে। সেখানে মিডল নোটকে হার্ট নোট বলে অভিহিত করা হয়েছে। এইকথা সত্যি যে কোনো পদার্থজাত গন্ধকেই বন্দী করা সম্ভব। ফলত মানুষের শরীর, তাদের ভিন্ন ঘামের গন্ধের মাত্রাকেও বোতলবন্দী করার কথা মানুষ ভেবেছে কারণ যদি সে উপযোগী পদ্ধতিতে ফ্যাট বা তেল থেকে তার গন্ধ সংরক্ষণ করতে পারে কিন্তু তাকে হত্যা না করে, তাহলে ফিল্মে কেন বাস্তবিকই তো মানুষ এইপথে এগোতে পারে! না মানুষ তা পারেনি কারণ তা অসম্ভব জটিল এবং যে লাভদায়ক হবেই তার কোনো স্বচ্ছ সূত্র নেই। তাই তা বাস্তবে সফল হয়নি কেবল সিনেমার গল্প হিসেবেই রয়ে গেছে সৌভাগ্যবশত। বিভিন্ন প্রাণীর ফেরোমন যে আছে তা যে মিলনে বিশেষ সাহায্য করে এটা মোটামুটি অনেকেই জানেন।মানুষের গায়ের গন্ধকে কয়েদ করা যায় বোতলে এই ভাবনা জনমানসে ছড়িয়ে পড়েছিল একসময়ে। সেই প্রকাশিত হল “পারফিউম” বইটি, যা মানুষের মন তোলপাড় করে দিয়েছিল। প্যাট্রিক সুসকেন্ড এর সেই উপন্যাস “পারফিউম” ; অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে জন্মানো সেই অনাথ শিশু যে এক চূড়ান্ত ঘ্রাণ শক্তিকে নিয়তি করে পৃথিবীতে এসেছিল মানুষকে পাগল করে দেওয়ার পারফিউম বানাতে; চরিত্রের নাম জ্যঁ ব্যাতিস্তা । এই উপন্যাসটি এত বিখ্যাত হয় যে এটি পরবর্তী ৪৯টি ভাষায় এটির অনুবাদ হয়। বিশ শতকের বেস্টসেলার মধ্যে এটি একটি। ২০০৬ সালে টম টিকওয়ার এই উপন্যাস অবলম্বনে “PERFUME :THE STORY OF A MURDERER” ফিল্মটি বানান।চূড়ান্ত জনপ্রিয় এই ছবিটির মূল প্রতিপাদ্যই ছিল একজন অতিরিক্ত ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে সুদক্ষ যুবা কীভাবে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নারীর দেহের গন্ধের আলাদা গুরুত্ব খুঁজে তাকে পারফিউম বানানোর কাজে লাগল। নারীদেহের জন্য সে একসময়ে একজন খুনিতে পরিণত হল। অথচ ফিল্মের শেষের সেই অতুলনীয় জনমিলন যার কারণ ছিল সেই খুনির তৈরী পারফিউমের এক বিন্দুর পাগল করা গন্ধ ।সবাই গন্ধে মোহিত হয়ে তাকে সরল হিসেবে, আত্মিক মানুষ হিসেবে অভিহিত করে তার কাছে নত হয়ে গেল। কেবলই গন্ধের ক্ষমতায়, গন্ধের বশ্যতায়। বিশিষ্ট অভিনেতা বেন হুইশ’হ -এর সেই অতুলনীয় অভিনয় জ্যান্ত করে তুলেছিল ফিল্মের প্রেক্ষাপট।  

গন্ধ আসলে জাদু।সচেতনকে খুন করে বেখেয়ালে নিয়ে যাবে বহুদূর।পাহাড়ের রাস্তা জুড়ে গন্ধ পেয়েছেন ইউক্যালিপ্টাসের কিম্বা শহরের রাস্তায় ছাতিম ফুলের? খুব চাপের মনও অতীব ক্যাবলা হয়ে কোথায় ভেসে চলে যায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে।গন্ধ আসলেই জাদু।গন্ধের মধ্যে সমস্ত গল্প বলা আছে। বাস্তবিকই আছে।তাই জন্যই তো কুকুরকে এত গুরুত্বের কাজে সামিল করা হয়! অ্যাম্বারগ্রিজের কথা বলেছিলাম।এবার বলব অ্যাম্বার, Bokhor /Bukhor এবং Agarwood ।অ্যাম্বার অ্যাম্বারগ্রিজের মতোই পারফিউম তৈরির কাঁচামাল।তবে এর আগমনকাল দীর্ঘ!কনিফার জাতীয় জীবজ উপাদানের জীবাশ্ম থেকে নিসৃত তেল বা রজনকেই অ্যাম্বার বলে।অ্যাম্বার নিয়ে এতই রহস্য যে একে নিয়ে মিথই প্রচলিত আছে।অ্যাম্বারগ্রিজ যেমন জলে ভাসে অ্যাম্বার কিন্তু তা নয়,তার ঘনত্ব অনেক বেশী।পারফিউমের যে ত্রিস্তরীয় নোট আছে সেখানে এর উত্তম প্রয়োগ হয়।আরবদেশে দেখেছি বহু পর্যটক Bokhor ও Agarwoo কে মিলিয়ে ফেলেন। Bokhor কিন্তু তৈরী করা জিনিস।Agarwood প্রকৃতি এক রহস্যময় যুদ্ধের খেলায় তৈরী করে।এর অর্থনৈতিক মূল্য চমকে দেওয়ার মতো।তবে এখন যাবতীয় ভুল ভাবনাদের সরিয়ে আদর্শ পারফিউম নির্মাতারা এই Agarwood সংগ্রহ করেন।অ্যাকুইলারিয়া নামক প্রজাতির কাষ্ঠল শাখা প্রশাখার ও মূল যখন এক ধরণের মোল্ড তথা ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন গাছ নিজেকে বাঁচাতে একপ্রকারের রজন নিসৃত করে।অল্প সক্রমণে -এর গন্ধ ও বর্ণ তেমন লক্ষণীয় নয়! যখন সংক্রমণ মাত্রাতিরিক্ত হয় তখন একপ্রকার গন্ধযুক্ত রজন নিসৃত হতেই থাকে গাছ থেকে। এই রজন এরপর ঘন শক্ত হয় ও গভীর বর্ণের রূপ নেয় গাছের অংশ হিসেবেই।এর অদ্ভুত গন্ধ তৈরি র ক্ষমতার জন্য এটি পারফিউম নির্মাতারা ব্যবহার করেন ।এটিই হল মূল মূল্যবান বস্তু।বিভিন্ন দেশে এর আকার,গুণগত মান জানলে অবাক হতে হয়।দুবাই এর বিখ্যাত “আল হারমাইন” পারফিউম কারখানার এক ধরণের প্রক্রিয়াকরণ নিজে চোখে দেখে অবাক হয়েছি। 

বখর হচ্ছে প্রক্রিয়াকরণ করা এর সঙ্গে জুঁইফুল কিম্বা চন্দনের অংশকে একত্রিত করে তৈরী করা কাঠের টুকরোর মতো ছোট ছোট দন্ড।ধূপেরই মতো এর ব্যবহার আরবের মানুষেরা ধর্মীয় কাজে লাগে।কিন্তু Agarwood হল সম্পূর্ণ প্রকৃতিজাত বস্তু।গাছ নিজেকে বাঁচানোর লড়াইয়ে এই মহামূল্য জিনিস বানায়।কখন এই ছত্রাক গাছকে ধরবে, কোন গাছকে কতখানি তীব্রতা দিয়ে আক্রমণ করবে, গাছ তার সঙ্গে কতখানি যুঝবে এই বিশাল এক জটিলতার মধ্যে দিয়ে Agarwood তৈরী হয়।তাই পৃথিবীর সেরা সেরা পারফিউম নির্মাতারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে একে সংগ্রহে রাখেন।পারফিউম তৈরী আসলে আদোর করে লেখা কবিতা।একটা প্রেমের লালন। এ যেন এক জাদুবাস্তবতা !

ভৌগোলিক পরিস্থিতি, গাছের প্রজাতি, সময় এইসমস্ত বিষয়ের ওপর তীব্রভাবে নির্ভর করে এর আবির্ভাব হয়। এদের প্রথম শ্রেণীর যে মান তা অতুলনীয় এবং তা সবচেয়ে দামী।অসমে একেই সাঁচি বলে।আরবে বলা হয় উদ( oud) । ফিলিপাইনসে, তামিলনাড়ু,তিব্বতেও এর ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। ১৪০০ খ্রি:পূ বেদে এর উল্লেখ পাওয়া যায় প্রথম।হিব্রু বাইবেলে এই নাম উল্লেখিত হয়েছে।মেটেরিয়া মেডিকাতে এর উপকারিতা কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। পারফিউম বানানোর মাধ্যমে হিসেবে যে ত্রিস্তরীয় নোট(note ) এর কথা বলেছিলাম। তার মধ্যে সবসময় মূলত Base note হিসেবে ব্যবহৃত হয় Agarwood।এরপর তার সঙ্গে ভিন্ন উপাদানের মিলনে ভিন্ন ভিন্ন গন্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়।।এ এক অতুলনীয় সৃজন যেন কবিতার শব্দ ধরে ধরে সুরের মূর্ছনায় ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে চরাচর।

Agarwood 

বিভিন্ন ধরণের পারফিউম

১ মিলিয়ন এর থেকে বেশী মূল্যের Agarwood










AGARWOOD প্রক্রিয়াকরণে শ্রমিকরা



পারফিউমের প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে


পারফিউম নিয়ে লেখার এই পর্বে নিজস্ব অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছি। গন্ধ যে আমাদের মধ্যে কতখানি জড়িয়ে তা আমরা খামখেয়ালিপনায় বুঝতে পারি না। চেনা গন্ধরা আমাদের মধ্যে আমাদের অজান্তেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে জন্মের পর থেকে। গন্ধকে যদি তীব্রভাবে বোঝেন, দেখবেন দেহ ছাড়িয়ে অন্তরের কোন এক কোণ থেকে এর জন্য টান বেরিয়ে আসছে। যেন আত্মার ঘ্রাণ। ১৯৭০ সালে আল হারামাইন পারফিউম কোম্পানির প্রতিষ্ঠা হয় মক্কা শহরে কাজী আব্দুল হকের হাত ধরে। সেই পারফিউমের প্রধান উৎসগত উপাদান ছিল AGARWOOD।এর কিছু বছর পরেই তাঁর সন্তান মহম্মদ মাহাতাবুর রহমান এই পারফিউম সম্পর্কিত চিরাচরিত ধরণকে এক ব্যতিক্রমী পথে নিয়ে যান; যেখানে গন্ধের নির্মাণশৈলী আভিজাত্যে পরিপূর্ণ। তিনি বর্তমানে এই কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ডিরেক্টর । সারা বিশ্বে তাদের প্রায় ১০০টি আউটলেট রয়েছে।প্রত্যেকটি আল হারামাইনের জিনিস (আতর, পারফিউম, ধুনা জাতীয় সামগ্রী, স্প্রে, সুগন্ধী তেল,বুখর) সঠিক পর্যবেক্ষণ, নির্মাণের ভিত্তিতে দুবাই শহরে নির্মিত (এক লক্ষ আশি হাজার স্কোয়ারফিটের পারফিউম নির্মাণ ক্ষেত্র)প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র হতে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে।এই নির্মাণশৈলী চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না! এত অপূর্ব সূক্ষ্ম ও শৃঙ্খলিত এই পদ্ধতি যা দেখলে সংবেদনশীল মানুষ বুঝবেন এই হল লালনের এক পদ্ধতি।মক্কা-মদিনা,দুবাই,কুয়েত,ওমান,কাতার, বাহরিন,বাংলাদেশ,লন্ডন,মরক্কো,নর্থ আফ্রিকা এই সমস্ত জায়গায় আল হারামাইন তার গন্ধের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।গত পঞ্চাশ বছরে তার বিস্তৃতি ও জনপ্রিয়তার রমরমা দেখলে অবাক হতে হয়। সিঙ্গাপুর,ফ্রান্স,ইতালি,রাশিয়া,ইস্তানবুল, কুয়েত এইসমস্ত জায়গার আন্তর্জাতিক মিলনমেলায় আল হারামাইন পারফিউম মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে মানুষের ঘ্রাণের অলফ্যাক্টরি স্নায়ু দুধরণের গন্ধের প্রতি সংবেদনশীল লিঙ্গের তারতম্যের দিক দিয়ে। সেই কথাকে মাথায় রেখে গন্ধের আকর্ষণীয় ক্ষমতার সাযুজ্যকে অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছে আল হারামাইন । তারা Oriental ও Floral এই দুই অংশের ব্যবহারিক প্রাধান্যে সুগন্ধী নির্মাণ করেছেন। তাদের নিজস্ব প্রায় ৫০০টির ওপর ব্র্যাণ্ড রয়েছে।কবিতার মতো করে ফুলেল বর্ণনায় এক একটি পারফিউমের ব্যতিক্রমী ভাব প্রকাশ করেছেন তারা। মানুষের মনন, আকাঙ্ক্ষা, প্রবৃত্তি ,লিঙ্গভিত্তিক চাহিদার তারতম্যকে মাথায় রেখে গন্ধের বিভিন্ন মাত্রাকে তারা এমনভাবে বোতলবন্দি করেছেন যার গন্ধ পেলে ম্যাজিকের মতো লাগে।AGARWOOD এর বৈচিত্র্য লক্ষ্য করার মতো। দেশ, ভৌগোলিক স্থান ভেদে তার আকৃতি, গুণগত মান, রং ও আকৃতি দেখার মতো।এর থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়া তথা HYDRODISTILLATION/SOLVENT EXTRACTION –এর মাধ্যমে এর তেল নিষ্কাশন করা হয়।এইবার এই তেল ভিন্ন নোট (Note) –এর মিশ্রণের আনুপাতিক নির্দিষ্ট পদ্ধতির দ্বারা ভিন্ন পদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পারফিউম প্রস্তুত করা হয়। পারফিউমের যে তিনটি স্তর তার ওপরেই তার গন্ধের গাঢ়ত্ব ও মেয়াদ নির্ভর করে। Base Note এ সাধারণ উদ্ভিজ্জ তেল এবং AMBER ,MUSK *, SANDLEWOOD, CEDARWOOD,AGARWOOD ব্যবহার করা হয়।পারফিউমের ১০ থেকে ২৫ শতাংশ এই স্তরের। তাই পারফিউম গায়ে দিলে এই অংশটাকেই দেহ শোষণ করে নেয় ভেতরে। ওপরের অংশের যে স্তর সে একটু বেশীই উদ্বায়ী।তবে মধ্যস্তরকে বলে Heart / middle note; এর উপাদানের ওপর অনেকখানি নির্ভর করে পারফিউমের গন্ধের স্থায়িত্ব। এবার আসি বিস্ময়কারী MUSK এর কথায়, এটি হল পরিণত মাস্ক পুরুষ হরিণের (কস্তুরী মৃগ) নাভি ও যৌনাঙ্গের মধ্যস্থ গ্রন্থি থেকে নিসৃত এবং সংশ্লেষিত,পিচ্ছিল পদার্থ যা ধীরে ধীরে কালচে খয়েরী কঠিন বস্তুতে পরিণত হয়। অ্যালকোহলে রেখে টিংচার তৈরীর মাধ্যমে এটি পারফিউমের জন্য উপযোগী পদার্থে পরিণত হয়। এই পৃথিবী যে পরিমাণ সম্ভারে পরিপূর্ণ তা ভাবলে ক্ষুদ্রতম বোধ হয় যা বলে বোঝানো যাবে না! চোখের সামনে দেখেছি শ্রমিকের পর শ্রমিক AGARWOOD কে পারফিউম বানানোর কাঁচামাল হিসেবে প্রস্তুত করছে। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে সূক্ষ্ম আতিথেয়তায় তারা যেন গন্ধের প্রেম নির্মাণ করছে। এই শ্রম যেন এক প্রেম, গন্ধের প্রেম! বড় বড় জারে ভিন্ন ভিন্ন কাঁচামালের সংরক্ষণ ,ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রায় অ্যালকোহলের সঙ্গে তেলের মিশ্রণ, তার Distillation, fixative এর ব্যবহার ইত্যাদি মহাযজ্ঞের মাধ্যমে পারফিউমের প্রকাশ। তিনটি note এর ভিন্ন ভিন্ন কাঁচামালের ব্যবহারে অতুলনীয় গন্ধের সব পারফিউম তৈরী করে আল হারামাইন।সেই দৃশ্য দেখার মাধ্যমে এক অদ্ভুত আনন্দ উপভোগ করেছি। এর যে প্রক্রিয়াকরণের শৈলী তা বড়ই সূক্ষ । বিশদে গিয়ে পাঠককে বিব্রত করছি না কারণ তার যে রাসায়নিক পদ্ধতি তাতে কিছু জটিলতা আছে যা কেবলই দক্ষ পারফিউম নির্মাতারা তাদের বিশেষ আয়ত্তে রেখেছেন। একটি বিশেষ জায়গায় তারা সমস্ত পারফিউমের স্যাম্পেল রেখে দিন। কিছু মাত্র সমালোচনামূলক বার্তা পেলে আবার তা নিয়ে পরীক্ষা চলে । প্রাণকে আদোরে বাঁচিয়ে রাখার মনুষ্যসমাজে এত সম্ভার তাতে এতো এতো গন্ধের মাদকতার জাদু লুকিয়ে আছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়!সেইসব উপাদান দক্ষ নির্মাতার হাতে এসে চরাচর ভরিয়ে দিচ্ছে এ স্বপ্ন ছাড়া কিছুই তো নয় তবে! কেলটিক সুরের মূর্ছনার মতো গন্ধের রাজ্য আভিজাত্যের আলোয় পরিপূর্ণ। আল হা্রামাইন প্রাইভেট লিমিটেড এর Femme (URBANIST) এবং JUNOON ব্যবহার করার সৌভাগ্য হয়েছে।এই গন্ধ আসলে রহস্য গল্পের গন্ধ। আপনাকে পাগল করে দেবে গন্ধের বাসনা অথচ উৎসহীন এক চূড়ান্ত মাদকতায় আপনি অস্থির হয়ে উঠতে পারেন। একেই হয়ত বলে গন্ধের জাদু। প্রত্যেকটি পারফিউম তৈরী করার জন্য আল হারামাইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা হল গন্ধের কারণের ব্যাখ্যা। অর্থাৎ গন্ধের পেছনে গল্প কোনটা? প্রেম , ব্যক্তিত্ব, নীরবতা, একাকী মুহূর্ত কোন গল্পের পারফিউম তারা? কোন উপাদানে তাদের বোতলবন্দী করা হয়? AGARWOOD এর বিশুদ্ধিকরণ , তেল নিষ্কাশন থেকে অ্যালকোহলের ব্যবহার, তার স্তরীভূত অংশের বিচ্ছিন্নকরণ এবং প্যাকেজিং -এর এক অতুলনীয় প্রক্রিয়াকরণ দেখার পর মনে হয়েছে এই পারফিউম শিল্প সত্যি সভ্য সমাজের আভিজাত্য ও বিলাসের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এর রূপায়নে এতো কেরামতি, এতো রহস্য যে অবাক হতে হয়। 

যেমন, এদের একটি পারফিউমের নাম HARAMAIN DAZZLE INTENCE 1936; এর বর্ণনায় প্রথমেই লেখা যদি আপনি অমীমাংসিত, অনন্ত গতির রহস্য-রোমাঞ্চের অধিকারী হতে চান তবে এই গন্ধ আপনার।এই পারফিউমের বেস নোটে(BASE NOTE) বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে কস্তুরী (মৃগনাভি সংলগ্ন গ্রন্থি বলে যা আমরা জানি), ভ্যানিলা এবং আরো কিছু দ্রব্য, মিডল(MIDDLE NOTE) তথা হার্ট নোটে রয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে পাম গাছ, জুঁই গাছ এবং টপ নোটে (TOP NOTE) আছে তেঁতুল,এলিমি এবং কমলার ফুল। এইসমস্ত জিনিসের নির্যাসের তেলের এক অপূর্ব মিশ্রণের আনুপাতিক প্রক্রিয়ায় এই পারফিউম তৈরী। পুরো যেন একটি কবিতার ছবি কিম্বা ছবির কবিতা। 

এর পর আসি আরেকটি ব্র্যান্ড “PORTFOLIO Euphoric Roots” ; এর Top note, Middle note. Base note –এর উপাদান হল যথাক্রমে ROSE, JASMINE,CITRUS পরবর্তী নোটে White flower,Berry তার পরবর্তীতে AMBER ,Musk. এই পারফিউমটি সম্পর্কে যা লেখা তা এক ঝরঝর রমণীয় মুক্ত গদ্যের মতো আপনার মনকে গলিয়ে দেবে । একটু অংশ আমি তুলে দিচ্ছি 

“with opening notes of Rose, Jasmine, Citrus that have been blended to open your senses to the wonder …….It then morphs to the well crafted aroma that well supported by white flower. Berry creating that blend of floral fruity that the homage to mother nature herself. Finally it settles to the long lasting fragrance of Amber, Musk and then you know you are whole”

সমস্ত পারফিউম আলাদা সময়, মনন, লিঙ্গভিত্তিক ভাবনাকে লালন করে বানানো হয়েছে যেন শিল্পীর বিভিন্ন সময়ের চিত্র।

গন্ধের রহস্য পতঙ্গ থেকে চতুষ্পদ হয়ে মানবে যে কত খেলা খেলছে তার কিছুমাত্রও আমরা সাধারণ অবস্থায় টের পাই না। আমরা শব্দ ও দৃশ্যকে এবং স্পর্শকে এত বেশী গুরুত্ব দিয়েছি যে গন্ধ আড়ালে আবডালে কতদূর শক্তিশালী তা ভুলে গেছি।





* এই লেখনীর কিছু অংশ পূর্বে একটি “দৈনিক সংবাদপত্রে” প্রকাশিত

Comments

Popular Posts